Home / রাজনীতি / বিএনপির শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দৃশ্যমান

বিএনপির শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দৃশ্যমান

শেরপুর ডেস্ক: সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা শুরুর তিন মাসের মধ্যেই আন্দোলন পরিচালনায় সমন্বয়হীনতা এবং শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দৃশ্যমান হয়। আন্দোলনের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ ও আলোচনা ছাড়াই রমজানে কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে এই অসন্তোষের সৃষ্টি। তবে গত রোববার বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের সেই অসন্তোষ বেশ প্রশমিত হয়েছে; কিন্তু গণতন্ত্র মঞ্চকে বিএনপি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে—এমন অভিযোগে শুরু থেকেই যুগপতের বাকি দল ও জোট শরিকরা অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে বিএনপির ১০ দফা দাবি ও ২৭ দফা রূপরেখা এবং গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও নতুন করে ৭ দফার ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের উদ্যোগে যারপরনাই অসন্তুষ্ট বাকি মিত্ররা। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সঙ্গে যৌথ বৈঠকে ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতারা ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ ইস্যুতে তাদের অসন্তোষের বিষয়টি প্রকাশও করেন। তাদের অভিযোগ, গণতন্ত্র মঞ্চের জোরাজুরিতেই বিএনপি মূলত ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নে বাধ্য হচ্ছে। এটা গণতন্ত্র মঞ্চকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফল। এ জন্য অতীতের মতো বিএনপিকে আবারও ভুগতে হবে। তবে বিএনপির দাবি, যুগপৎ আন্দোলন পরিচালনায় কোনো সমন্বয়হীনতা নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও যুগপতের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ১০ দফার ভিত্তিতে সুশৃঙ্খলভাবে যুগপৎ আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। শরিক দল ও জোটগুলোও সাধ্যমতো যুগপতের কর্মসূচি পালন করছে। জনগণের অংশগ্রহণে আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হচ্ছে। এখানে কোনো সমন্বয়হীনতা নেই। শরিকদের লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করেই সাধারণত যুগপতের কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। কর্মসূচি প্রণয়নে ‘কোর কমিটি’ গঠনের প্রক্রিয়া এগোচ্ছে বলে জানান তিনি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় এবার আন্দোলন পরিচালনা ও কর্মসূচি প্রণয়নসহ নেতৃত্ব নিজেদের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এতদিন ধরে কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে শরিক দল ও জোটগুলোর লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে তাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য কর্মসূচির প্রস্তাবনা নিত বিএনপি। পরে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কর্মসূচি চূড়ান্ত হওয়ার পর শরিকদের তা জানিয়ে দেওয়া হতো। ফোনে মেসেজের মাধ্যমে, কখনো নতুন কর্মসূচি ঘোষণার দিন সকালে আবার কখনো আগের দিন রাতে জোট শরিকদের তা জানানো হতো। অবশ্য এ নিয়ে তখন শরিকদের মধ্যে অনেকে অসন্তুষ্ট ছিল। তবে এই অসন্তোষ আরও তীব্র হয় যখন রমজানে শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই বিএনপি এককভাবে যুগপতের কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। ফোনে মেসেজের মাধ্যমে শরিকদের তা জানিয়ে দেওয়া হয়।

গত ২৪ মার্চ রাজধানীর লেডিস ক্লাবে আলেম-ওলামা ও এতিমদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির প্রতিবাদ এবং পূর্বঘোষিত ১০ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে যুগপতের নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঘোষণা অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের সব মহানগর ও জেলায় দুই ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। এ ছাড়া আগামীকাল শনিবার দেশের সব মহানগরের থানা ও জেলার উপজেলা পর্যায়ে বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালিত হবে। এদিন একযোগে দেশের ৬৫০ স্থানে এই কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। আর ৯ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগ অনুযায়ী বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রচারপত্র বিতরণ অথবা মানববন্ধন কিংবা অবস্থান কর্মসূচি পালিত হবে।

জানা যায়, আন্দোলন ও নির্বাচনের বছর হওয়ায় তৃণমূলের চাঙ্গাভাব ধরে রাখা এবং আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রমজান মাসেও মাঠের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। তবে যুগপতের শরিকরা রোজার মাসে মাঠের কর্মসূচির বিপক্ষে ছিল। গণতন্ত্র মঞ্চ গত শনিবার কর্মসূচি করেনি। তারা পরে সোমবার রাজধানীতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। আর ১২ দলীয় জোট রমজানে প্রথম কর্মসূচি করলেও যুগপতের পরবর্তী কর্মসূচিগুলো না-ও করতে পারে।

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার কালবেলাকে বলেন, ‘১২ দলীয় জোট রমজানে যুগপতের প্রথম কর্মসূচি পালন করেছে। তবে সেখান থেকে নতুন কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। জোটে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তবে জানা গেছে, মূলত সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই ১২ দল রমজানে যুগপতের বাকি কর্মসূচিগুলো পালন করতে চায় না।

গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। পরে আন্দোলন সমন্বয় করতে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়। শরিক দল ও জোটগুলোর লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হতো; কিন্তু তাতে একপর্যায়ে গিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বিএনপির বৈঠক হয়। সেখানে যুগপৎ আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে ‘কোর কমিটি’ গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলোর একজন করে প্রতিনিধি সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হওয়ার কথা। ওই বৈঠকে কোর কমিটির জন্য গণতন্ত্র মঞ্চের কাছে প্রতিনিধির নামও চাওয়া হয়। তখন মঞ্চের পক্ষ থেকে জোটগতভাবে আলোচনা সাপেক্ষে নাম দেওয়ার কথা জানানো হয়; কিন্তু পরে উদ্যোগটি আর এগোয়নি। আলোচনা না হওয়ায় যুগপতের বাকি শরিকরাও বিষয়টিতে অন্ধকারে রয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, বিএনপির ১০ দফা দাবি ও ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার সমন্বয়ে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ প্রস্তুত করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বসে যৌথ ঘোষণাপত্রের ৭ দফা একটা খসড়াও প্রণয়ন করেন। তবে বিষয়টিতে অন্ধকারে থেকে যায় যুগপতের বাকি শরিকরা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে একত্রে বিএনপির বৈঠক হয়। সেখানে দুই জোটের কয়েকজন নেতা ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের বিষয়টি উত্থাপন করে বলেন, গণমাধ্যমে খবর এসেছে—বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ মিলে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্রের ৭ দফা খসড়া প্রণয়ন করেছে; কিন্তু এ বিষয়ে আমরা শরিকরা কিছুই জানি না। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তাব। আমরা এখনো তাতে সম্মত হয়নি। যখন বিষয়টি এগোবে তখন আপনাদের মতামতও নেওয়া হবে।

এদিকে রমজানে এককভাবে যুগপতের কর্মসূচি ঘোষণায় শরিকদের অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। সেখানে ঈদের পর আন্দোলনের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ এবং শরিক দল ও জোটের লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যুগপতের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। জানা যায়, বৈঠকে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ ইস্যুতে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা দ্রুতই এটি ঘোষণা করতে চায়; কিন্তু এটি নিয়ে যুগপতের বাকি শরিকদের সঙ্গে যেমন আলোচনা এখনো শেষ হয়নি, তেমনি স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি এগোয়নি। সেজন্য যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।

বৈঠক প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতা জানান, ঈদুল ফিতরের পর বড় আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তার আগেই আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে। তিনি আরও বলেন, সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলন পরিচালনা এবং কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে এর আগে একটি ‘কোর কমিটি’ গঠনের কথা বলা হয়েছিল; কিন্তু উদ্যোগটি পরে আর এগোয়নি। রোববারের বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। বিএনপি এখন শরিক দল ও জোটগুলোর লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যুগপতের কর্মসূচি প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

জানা যায়, গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় যুগপৎ আন্দোলনের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’র ৭ দফা খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে নীতি-নির্ধারকদের কয়েকজন বলেন, বিএনপির দেওয়া ১০ দফা ঠিক রেখে সমমনা দলগুলোর দাবি তাতে যুক্ত করা যেতে পারে। তবে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি, স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো বিএনপি এখন গণতন্ত্র মঞ্চকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ যুগপতের বাকি শরিকদের। জোটের এক নেতা বলেন, তৎকালীন ২০ দলীয় জোটের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভিন্ন মতাদর্শের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করে ভোটে যায় বিএনপি। ওটা ছিল ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার একটি সরকারি কৌশল। সেই কৌশলে সরকার তখন সফলও হয়। এবারও বিএনপি সেসব নেতাদের গুরুত্ব দিচ্ছে, যারা এখন গণতন্ত্র মঞ্চে রয়েছে। বিএনপি যদি সেটা বুঝতে না পারে, তাহলে সেজন্য অতীতের মতো তাদের আবারও মাশুল দিতে হবে। ১০ দফা দাবি ও ২৭ দফা রূপরেখার বাইরে নতুন করে যুগপতের ৭ দফা প্রণয়নের বিরোধিতা করেন তিনি। তার দাবি, এতে করে জনগণ বিভ্রান্ত হবে।

জানা গেছে, যুগপতের বাকি শরিকদের অসন্তোষ প্রশমনে তাদের সঙ্গেও বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। আজ শুক্রবার ১২ দলীয় জোট এবং আগামীকাল শনিবার জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বৈঠক করবেন। সব অসন্তোষ, মনোমালিন্য, সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে ঈদের পরে বড় আন্দোলনে নামতে চায় দলটি।

Check Also

রাষ্ট্র সংস্কারে প্রস্তাব দেবে বিএনপি

শেরপুর নিউজ ডেস্ক: অন্তর্বর্তী সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করবে বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − 4 =

Contact Us