শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেয়ার নামে প্রতারণায় গ্রেপ্তার ৮

শেরপুর নিউজ ডেস্ক: সারাদেশে ২ হাজারের বেশী সক্রিয় এজেন্ট বা সদস্য রয়েছে এ চক্রের। এক রকম শেয়ার বাজারের মতো দরকষাকষি করে তাদের হাজারে ৩০-৪০ টাকা কমিশনে প্রতারণার কাজ দেয়া হয়। এজেন্ট হতে হলে দিতে হয় অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও, চক্রটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজসহ মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলতো। বিভিন্ন সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় সংগ্রহ করা হতো। প্রতারণার টাকা চক্রের সদস্যের মধ্যে বণ্টন করার পর কমিশন ও কাজের খরচা বাবদ এজেন্টদের দেয়া হতো নির্ধারিত টাকা।

শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেয়ার নাম করে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাতে জড়িত ৮ জনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‍্যাব-৫ এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস। সোমবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

র‍্যাব-৫ এর সিও জানান, র‍্যাব-৫, ৪, ৮, ১০, ১১ ও ১৪ এর যৌথ দল সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতের ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, কুমিল্লা ও ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলিয়ে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তাররা হলেন, এ চক্রের হোতা জাকির হোসেন হাওলাদার (৪৭), অন্যতম হোতা মো. বাপ্পি মোল্লা (২০), মো. উসমান গনি মোল্লা (৩৩), শামীম হোসেন (২৯), মোহাম্মদ জিহাদ (৩৪), কাজী সাদ্দাম হোসেন ওরফে আমির হামজা (২৬), মো. আহাদ গাজী (২৪) ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জয় (২৬)।

একটি ঘটনা উল্লেখ করে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, গত ২৪ মার্চ রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানাধীন শালবাগান রাজশাহীর বিএনসিসি অফিসে অবস্থানকালে এক ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বর থেকে মেয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাউন্টেট শাখায় কর্মরত মিজানুর রহমান বলে পরিচয় দিয়ে তার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় শিক্ষা উপবৃত্তির ২২ হাজার ৫০০ টাকা এসেছে বলে জানায়। ওই টাকা বাদীর একাউন্টে চলে যাবে মর্মে একটি ব্যাংকের এটিএম কার্ডের ১৬ ডিজিটের নাম্বার দিতে বললে তিনি তার ১৬ ডিজিটের নাম্বার প্রদান করেন। এরপর ওটিপি যাবে বলে জানায়। পরবর্তীতে বাদী মোবাইল মেসেজ অপশনে দেখতে পায় বাদীর একাউন্ট থেকে চার বারে এক লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ওই ঘটনায় তিনি বাদী অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে আরএমপির বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানায়, সে শুধুমাত্র মাঠ পর্যায়ে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট হতে টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন ব্যাংকের একাউন্টে প্রেরণ করতো। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন কোম্পানির সিম কার্ডসহ বেশ কয়েকটি মোবাইল উদ্ধার করে। এরপর একে একে মূল হোতা জাকিরসহ বাকিদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ ২৩টি মোবাইল সেট, ৩১০টি সিম কার্ড, নগদ-৩ লাখ ১২৭০ টাকা ও ৯টি ব্যাংক লেনদেন স্লিপ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত প্রত্যেকটি সিম কার্ডে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংর এর একাউন্ট রয়েছে।

এলাকায় পরিচিতি ওয়েলকাম ও হ্যালো গ্রুপের সদস্য হিসেবে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সরকারি অফিস থেকে শিক্ষা উপবৃত্তি টাকা দেয়ার তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর তারা ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের কলিং সেন্টারে শেয়ার করে। পরে তাদের মূল হোতা জাকির হোসেনের দুই ছেলে মানিক ও হিরা ফোন দিয়ে কথা বলে বিশ্বস্ততা অর্জন করে এবং ওটিপি হাতিয়ে নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৫ অধিনায়ক বলেন, ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের রয়েছে সারাদেশে ২ হাজারের বেশি এজেন্ট। এজেন্ট হতে হলে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এন্ট্রি করতে হয়। এরপর মোবাইলে তাদের নামে একটা একাউন্ট হয়। ইতোমধ্যে তদন্তে ১৮৬১ টি মোবাইল নাম্বার সনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে টাকা লেনদেন ও যোগাযোগ হয়েছে।

হাজারে এজেন্ট কমিশন পায় ৩০/৪৯ টাকা- হাজারে ৩০ বা ৪০ টাকা কমিশন পাবার চুক্তিতে প্রতারণার কাজে এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এজেন্টের এন্ট্রিকৃত মোবাইল একাউন্টে টাকা যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড থাকে মূল চক্রের হাতে। টাকা ঢোকা মাত্র তারা তুলে নেয়।

শহর থেকে দূরে অবস্থান করে চক্রের সদস্যরা, তাছাড়া তারা এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। মূল শহর থেকে ১৫/১৬ কিমি দূরে অবস্থান করেন। টাকা ঢোকা মাত্র নিকটস্থ কোনো এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করেন। তারা নিজেরা অন্য কোন যানবাহনে চলাচল না করে মোটরসাইকেলে চলাচল করেন। বাড়িতে না থেকে নির্জন কোন যায়গায় থাকেন।

বংশ পরম্পরায়ও অনেকে জড়িয়েছে প্রতারণায়। এই প্রতারণাকে তারা ব্যবসা হিসেবে দেখেন খারাপ কিছু ভাবেন না। তারা শুধু নিজেরা নন পারিবারকেও তারা এই ব্যবসায় জড়িয়েছেন। প্রতারক চক্রে বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনরাও প্রভাবিত হয়ে অনেকে এই অভিনব প্রতারণা কাজে জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে।

লে. কর্নেল মনির বলেন, খোকন মোল্লা এই প্রতারণায় জড়িত। অভিযানের সংবাদে পলাতক খোকন মোল্লার ছেলে বাপ্পি মোল্লাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আমরা জানতে পেরেছি খোকন মোল্লার মোবাইলে একদিনে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা এসেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

অন্যদিকে মূলহোতা জাকির হোসেন হাওলাদারকে গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইলে দেখা গেছে, দুই লক্ষাধিক টাকা আদানপ্রদান হয়েছে।

শেয়ারবাজারের ন্যায় দর কষাকষি করে প্রতারণার কাজ বন্টন করা হয়। চক্রের যারা সদস্য রয়েছে তাদের মধ্যে দর কষাকষি হয়। এক রকম শেয়ার বাজারের লেনদেনের মত দর উঠানামা করে। কে কত টাকায় এই প্রতারণামূলক কাজটি করবে। কেউ হাজার টাকায় ৪০ টাকা কেউ হাজার টাকায় ৩০ টাকা কমিশন পেতে কাজটি নেয়। তাদের মধ্যে যারা পারদর্শী ও বিশ্বস্ত তাদেরকে কাজটি দেয়া হয়। অর্থ আত্মসাতের কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর সেই এজেন্ট নিজের প্রাপ্ত অংশ রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপর প্রচার চক্রের মূলহোতা বাকি টাকা বন্টন করে দেন।

প্রতারণায় ব্যবহার করা হয় অন্যের সিম। চক্রটির সঙ্গে জড়িত একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহারর জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে।

একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম বিক্রেতা গ্রেপ্তার আহাদ গাজী। কোম্পানি থেকে টার্গেট থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ সিম বিক্রি করতে হবে বিক্রি করতে না পারলে তাকে চাপে থাকতে হয়। এজন্য বিভিন্ন লোক আসলেই তারা ৫০-১০০ টাকা সিম বিক্রি করে। যদিও এই সিম ফ্রিতে দেওয়ার কথা। বিভিন্ন সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে সিম বিক্রি। কেউ ফেরত দিলে সেটি পুনরায় বিক্রি করে এই প্রতারক চক্রের কাছে। ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় এসব সিম সংগ্রহ করে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে প্রতারক চক্রটি।